ইরানে কিভাবে ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল? How was the Islamic government of Iran established?

ইরান নিয়ে কমবেশি আমাদের সবারই অনেক আগ্রহ রয়েছে। আমরা অনেকেই হয়ত জানিনা ৪০ বছর আগেও ইরানে ছিল পশ্চিমাপন্থি এক নাস্তিক সরকার। কারণ, আধুনিক যুগে ধর্ম-ভিত্তিক রাষ্ট্র-ব্যবস্থার পুনরুজ্জীবন ঘটতে পারে-এটা সমাজ ও রাষ্ট্র-বিজ্ঞানীদের কাছে ছিল কল্পনাতীত বিষয়। পাশ্চাত্যে ধর্ম কেবলই ব্যক্তি-জীবনে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছিল। 

পশ্চিমাদের অনুগত বা তাদের সেবাদাস শাসক-গোষ্ঠীর সহায়তায় মুসলিম বিশ্বেও ধর্মকে জীবনের সব ক্ষেত্রে থেকে নির্বাসন দেয়ার অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছিল পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত বুদ্ধিজীবি মহলের এক বড় অংশ। কিন্তু এমন এক প্রেক্ষাপটে ইরানের ইসলামী বিপ্লব বদলে দেয় বিশ্ব-রাজনীতি ও সমাজ-ব্যবস্থার প্রচলিত সব হিসাব-নিকাশ।


আর আজকে আপনাদেরকে জানানোর চেষ্টা করবঃ

 

১। ইরানে নাস্তিকদের সরিয়ে যেভাবে ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠা হল!

২। ইসলামী বিপ্লবের ৪০ বছর পরও যেভাবে টিকে রয়েছে ইরানের ইসলামি সরকার ব্যবস্থা।

৩। আমেরিকা কেন ইরান আক্রমণ করতে ভয় পায়?

৪। ইরান কিভাবে শক্তিশালী সামরিক বাহিনী প্রতিষ্ঠা করল?


এই লেখাটি নিয়ে Video দেখতে চাইলে Video লেখাতে ক্লিক করুন।


Afghanistan,Geopolitics,Jerusalem,History,World,Middle East,Economy,Islam,Asia,Country Info,America,Al-Aqsa,Features,Latest,

মূল বিষয়ে যাওয়ার আগে দুটি কথা বলা অবশ্যই জরুরী। এখানে অনেক কিছুই বলা হবে যা হয়তো অনেকেরই পছন্দ হবে না। কমেন্ট বক্সে অনেকেই হয়ত শিয়া ট্যাগ দিবে। কিন্তু সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ভাবেই তৈরি করা হয়েছে আমাদের এই লেখাটি। আজকে এমন অনেক তথ্য জানাবো যা হয়ত আগে জানতেন না। কাজেই সম্পূর্ণ লেখাটির শেষ পর্যন্ত পড়ার অনুরোধ রইলো।


আর যারা জিওপলিটিক্স ও বিশ্বের সকল মুসলিম দেশ সম্পর্কে জানতে চান তাহলে অবশ্যই আমাদের YouTube চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করবেন। এবার যাওয়া যাক মূল বিষয়ে।


১৯৭৯ সালের ১১ ফেব্রুয়ারিতে বিজয়ী-হওয়া ইরানের ইসলামী বিপ্লব দেশটিতে অবসান ঘটায় মার্কিন কর্তৃত্বসহ তাবৎ পরাশক্তিগুলোর মোড়লিপনা। এ বিপ্লব ফিরিয়ে আনে ইরানি জাতির প্রকৃত স্বাধীনতা। কিন্তু এ বিপ্লবের ফলে দিশেহারা হয়ে পড়ে মার্কিন পরাশক্তি ও তার মিত্ররা। গত প্রায় চার দশক ধরে একের পর এক চক্রান্ত করে যাচ্ছে যাতে বেরথ হয়ে যায় ইরানের ইসলামী বিপ্লব। 


এসব ষড়যন্ত্র অনুযায়ী আমেরিকা কখনও পরোক্ষ যুদ্ধ, কখনও প্রত্যক্ষ সামরিক আগ্রাসন কিংবা কখনও কঠোর অর্থনৈতিক অবরোধসহ নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যাচ্ছে ইরানের উপর। অবশ্য মার্কিন নেতৃত্বাধীন ওইসব দাম্ভিক পরাশক্তির চাপিয়ে দেয়া নানা শত্রুতা সত্ত্বেও ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে।


তবে ইরানের এই ইসলামী বিপ্লব সফল হওয়ার অন্যতম কারণ ছিল ইউরোপীয় দেশ গুলোর ইরানের পক্ষে অবস্থান নেওয়া। ইরান ইস্যুতে পশ্চিমাদের মধ্যে রয়েছে দ্বিধা ভিবক্ত মতামত। বিশেষ করে ইউরোপের কোন দেশ ইরানের উপরে অবরোধ দেওয়ার পক্ষে নয়, আর বিপরীতে আমেরিকা ও ইজরায়েল হচ্ছে ইরানের প্রধান শত্রু।


Afghanistan,Geopolitics,Jerusalem,History,World,Middle East,Economy,Islam,Asia,Country Info,America,Al-Aqsa,Features,Latest,

এখন অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন আমেরিকা ইজরায়েল যেহেতু ইরানের শত্রু তাহলে ইউরোপের দেশ গুলো কেন ইরানের পক্ষে অবস্থান নিচ্ছে? 


এই প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে আমাদেরকে ফিরে যেতে হবে ১৯৬৭ সালের আরব ইজরায়েল যুদ্ধের সময়ে। ১৯৬৭ সালে ৬ দিনের আরব ইজরায়েল যুদ্ধ বদলে দিয়েছিল মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির গতিপথ। মিশর, সিরিয়া, জর্ডান, লেবানন, ইরাকের বিপক্ষে যুদ্ধ করেছিল ইজরায়েল। মাত্র ৬ দিনের যুদ্ধে ইজরায়েল জয়ী হয়। ইজরায়েল জর্ডানের হাত থেকে সম্পূর্ণ ভাবে দখল করে নেয়ে জেরুজালেম শহর।


এই যুদ্ধে পরাজয় ছিল আরবদের জন্য সবচেয়ে লজ্জার। এই যুদ্ধে পরাজয়ের কারণে বিশ্ব রাজনীতিতে আরব দেশ গুলোর ক্ষমতা ও গুরত্ত কমে যায় অনেকটা। পশ্চিমারা আরব দেশ গুলোকে পাত্তা দেওয়া বন্ধ করে দেয়ে। বিশ্ব রাজনীতিতে আরব নেতাদের আর কোন মূল্যই থাকে না তখন।


এমন পরিস্থিতিতে ১৯৭৩ সালে সৌদি আরবের নেতৃত্বে আরব দেশ গুলো পশ্চিমাদের কাছে তেল বিক্রি করা বন্ধ করে দেয়ে। যা ওয়েল ক্রাইসিস বা ওয়েল এম্বারগো নামে পরিচিত। আরব দেশ গুলোর অভিযোগ ছিল পশ্চিমারা ইজরায়েলকে অবৈধ ভাবে সাহায্য করে আসছে, এবং ইজরায়েল একটি কলোনিয়াল সেটেলমেন্ট। 


আরবদের তেল অবরোধের ফলে পশ্চিমা অর্থনীতি বিশাল বড় এক ধাক্কা খায়। আরব দেশ গুলোর তেল অবরোধ দেওয়ার কারণে ইউরোপ ও আমেরিকার বাজারে তেলের দাম বেড়ে যায় ৩০০ গুন। এক ব্যারেল তেলের দাম ৩ মার্কিন ডলার থেকে বেড়ে হয়ে যায় ১২ মার্কিন ডলার। ইউরোপ আমেরিকার সবাই যখন তেলের জন্য হাহাকার করছে ঠিক তখনই শয়তানের সেনাপতি আমেরিকা হাজির হয় বিশাল এক কুপরিকল্পনা নিয়ে।


সৌদি আরব ও ওপেকের সাথে আমেরিকার চুক্তি হয় যা পেট্রো ডলার চুক্তি নামে পরিচিত। চুক্তির শর্ত হচ্ছে ওপেকের আওতাভুক্ত সকল দেশ তেল বিক্রি করবে শুধুমাত্র মার্কিন ডলারে। আমেরিকা ও ওপেকের এই চুক্তির কারণে ইউরোপের সকল দেশ তখন আমেরিকার হাতে জিম্মি হয়ে যায়। আর আমেরিকা এটার ফায়দা নেয়ে, ইউরোপের দেশ গুলো তেল কিনতে হলে আমেরিকাকে ইয়েস স্যার বলে আমেরিকার কাছ থেকে ডলার নিতে হত। 


আর এই বিষয়টাই ইউরোপীয় দেশ গুলো পছন্দ করেনি। ঠিক এমনই সময় আফগানিস্তানে সোভিয়েত বিরোধী আন্দোলন, আর ইরানে শুরু হয় আমেরিকার দালাল রেজা শাহ্‌ এর বিরুদ্ধে গন আন্দোলন। আর এই সুযোগটাকেই কাজে লাগায় ইউরোপীয়রা। 


ইরানের ইসলামী বিপ্লবের সময় জনাব রুহুল্লা খমেনি অবস্থান করতেন ফ্রান্সে, তিনি ফ্রান্স থেকেই সম্পূর্ণ ইসলামী বিপ্লবের নেতৃত্ব দিতেন। ইরানের ইসলামী বিপ্লবের সময় জার্মানি, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ফ্রান্স, ইটালি সবাই গোপনে ইরানের বিপ্লবকে সাপোর্ট দিয়েছে।


সোভিয়েত ইউনিয়ন চাচ্ছিল যেকোনো ভাবে ইরান থেকে আমেরিকান পন্থী সরকারকে উৎখাত করতে এবং সোভিয়েত পন্থী সরকার তৈরি করতে। আর বিপরীতে আমেরিকা চাচ্ছিল আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত পন্থী সরকারকে উৎখাত করে আমেরিকা পন্থী সরকার তৈরি করা।


দুই শয়তান পরিকল্পনা করেছিল, দুই শয়তানের পরিকল্পনাই অর্ধেক সফল হয়েছিল। কারণ ইরান থেকে উৎখাত করা হয় আমেরিকার দালাল রেজা শাহ্‌কে, কিন্তু প্রতিষ্ঠিত হয় ইসলামিক সরকার, যারা সোভিয়েত নাস্তিকদের মতের বিপরীত। 

আর আফগানিস্তান থেকেও উৎখাত হয় সোভিয়েত নাস্তিক সরকার। কিন্তু প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ইসলামিক ইমিরাত, যারা আদর্শিক দিক দিয়ে আমেরিকান সেকুলারিজমের ঘোর বিরোধি।


১৯৭৯ সালে ইরানের ইসলামিক বিপ্লবের পরে ইরান ওপেকের ভিতরে থেকেই ডলারের পাশাপাশি অন্যান্য মুদ্রায় গোপনে তেল বিক্রি করা শুরু করে। ইরানের ইসলামিক সরকার এমন একটি সিধান্ত নিবে এমন আশা থেকেই ইউরোপীয় দেশ গুলো ইরানের ইসলামিক বিপ্লবকে সাপোর্ট দিয়েছিল।


১৯৯৯ সালে ইউরোপে যখন নতুন মুদ্রা চালু করে এর কয়েক বছর পরে ২০০৩ সাল থেকে ইরান ইউরোতেও তেল বিক্রির সিধান্ত নেয়ে। এর ফলে ইউরোপের দেশগুলোকে আর আমেরিকার কাছে গিয়ে ইয়েস স্যার করতে হয় না। ইউরোপ এখন নিজেদের মুদ্রা ইউরোতে তেল কিনতে পারছে। ১৯৭৯ সালের আগে ইউরোপীয়রা নানা ভাবে আমেরিকার কাছ থেকে প্রতারিত হত। আমেরিকা ডলারের বিনিময়ে প্রায় সময়ই ইউরোপের কাছ থেকে অবৈধ সুবিধা নিত।


বর্তমানে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের অন্যতম সঙ্গী হচ্ছে ইউরোপ, রাশিয়া এবং চীন। চীন, রাশিয়া ইউরোপ কোন ভাবেই চায় না ইরান আগের মত ডলারের বিনিময়ে তেল বিক্রির চুক্তিতে ফিরে যাক। ঠিক এই কারণেই আমেরিকা যখন ইরানের উপরে অবরোধ দেওয়ার চেষ্টা করে ইউরোপ ও চীন সব সময় ঐ অবরোধের বিপক্ষে অবস্থান নেয়ে।


আর ইরানের ইসলামিক সরকার এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের সামরিক বাহিনীকে যথেষ্ট শক্তিশালী করে তৈরি করে। আমেরিকা ইরানের বিরদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে না যাওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে আমেরিকা জানে আমেরিকা যদি ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়ায় তাহলে এই যুদ্ধে রাশিয়া, চীন সরাসরি ইরানকে সাপোর্ট দিবে আর ইউরোপ সাপোর্ট দিবে গোপনে। ইরানের মত শক্তিশালী দেশের বিপক্ষে লম্বা সময় ধরে যুদ্ধ করার মত সামর্থ্য আমেরিকার নেই। দেখা যাবে ইরান যুদ্ধটিই হয়ে যাবে আমেরিকার জন্য মরন ফাঁদ।


কারণ রাশিয়া চীন ও ইউরোপ কোন ভাবেই চাইবে না ইরানে আবার আমেরিকান পন্থী কোন সরকার প্রতিষ্ঠিত হোক, আমেরিকান পন্থী সরকার তৈরি হলে ইরান হয়ত আবার ডলার বেবস্থায় ফিরে যাবে। যদি এমনটা হয় তাহলে দেখা যাবে চীন ও ইউরোপ উভয়েই আমেরিকার কাছে জিম্মি হয়ে যাবে। আর ঠিক এই কারণেই রাশিয়া, চীন ও ইউরোপ যেকোনো পরিস্থিতে ইরানের ইসলামী সরকারকে সাপোর্ট দিয়ে যাবে। আর এত গুলো শক্তির বিপক্ষে আমেরিকার একার পক্ষে যুদ্ধ করার ক্ষমতাও নেই।


Iran, Saudi Arabia, Turkey, Iraq, Afghanistan, Country Info

২০১৭ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যখন ইরানের সাথে করা জেসিপোয়া চুক্তি থেকে বের হয়ে যায়, তখন ইউরোপের সকল দেশ এর সমালোচনা করে। আমেরিকা চুক্তি থেকে বের হয়ে গেলেও ফ্রান্স, ব্রিটেন, জার্মানি, চীন, রাশিয়া এরা কেউই ঐ চুক্তি থেকে বের হয়নি। এরা সবাই ইরানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। 


ইউরোপ আমেরিকার ডলার বনাম ইউরোর লড়াই, চীন আমেরিকার বিশ্ব মোড়লগিরি নিয়ে লড়াইকে, খুব কৌশলে কাজে লাগিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ইরানের ইসলামিক সরকার। পশ্চিমাদের নিজেদের মধ্যে এই স্বার্থের দন্ধকে কাজে লাগিয়ে ইরান যখন তৈরি করে ফেলেছে নিজেদের শক্তিশালী সামরিক বাহিনী। আর তখন আরব দেশ গুলো এই সুযোগে তৈরি করছে বিশাল বিশাল নাইটক্লাব। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করছে ফুটবল ক্লাবের মত ফালতু জিনিসের পিছনে।


আশাকরি সবাই বুঝতে পেরেছেন। আজকের মত বিদায় নিচ্ছি, আবারও দেখা হবে আগামী ভিডিওতে। সেই পর্যন্ত সবাই ভাল থাকবেন আর চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করে আমাদের সাথেই থাকবেন। যারা অলরেডি চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করেছেন তাদেরকে ধন্যবাদ।  আল্লাহ হাফেজ।


0 Comments